অদর্শন
ভিন্ন জীবন, ভিন্ন বৃষ্টি: কারো কাছে আনন্দ, কারো কাছে কান্না
আপনি যখন আনন্দ নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছেন। আমি তখন দুঃখ নিয়ে টিনের ফুটোকে পানি পড়া থেকে আটকাতে চাচ্ছি।
আপনার কাছে এই বর্ষা, এই ভিজে যাওয়ার মুহূর্ত এক অন্যরকম রোমান্স নিয়ে আসে। আপনি হয়তো দাড়িয়ে আছেন ব্যালকনিতে এক কাপ চায়ের সঙ্গে, চোখ মেলে দেখছেন কেমন করে ঝরছে আকাশের মুক্তা। অথচ আমি সেই একই সময় একটা ভাঙা মগ হাতে দৌড়চ্ছি, একটা ফুটো বন্ধ করতে গিয়ে আরেকটা খুলে যাচ্ছে। বৃষ্টি কারো কাছে স্বস্তির, আর কারো কাছে যুদ্ধের মতো।
আগে দু-একটি ফুটো ছিলো তখন বালতি বা বোল দিয়ে সে পানি ধরতাম।
তখনও জীবনটা কষ্টের ছিল, কিন্তু তা ছিল কিছুটা সামাল দেওয়ার মতো। এক হাতে ছাতা ধরতাম, আরেক হাতে ধরে রাখতাম আশার শেষ প্রান্তটুকু। এখন যতগুলো ফুটো হয়েছে, ততগুলো বালতি আমার কাছে নেই।
সময় যত এগিয়েছে, ততই যেন বিপদ বেড়েছে, আর সেই অনুযায়ী সামর্থ্য কমেছে। পুরোনো টিন, ভাঙা চাল, আর অগোছালো জীবন নিয়ে এখন আমি যেন এক অসহায় সৈনিক, যার অস্ত্রও নেই, আশ্রয়ও নেই। আপনি হয়তো ভাবছেন, এ তো সামান্য বৃষ্টির গল্প। কিন্তু আমার কাছে এটা এক জীবনের প্রতিচ্ছবি।
বৃষ্টিতে আপনার সুখ আর আমার দুঃখ।
এই একটি বাক্য যেন পুরো সমাজের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন যখন বৃষ্টিকে নিয়ে কবিতা লেখেন, গান বাঁধেন, তখন অন্য কেউ হয়তো সেই বৃষ্টির মধ্যেই সিক্ত হচ্ছে না, বরং ডুবে যাচ্ছে দৈনন্দিন বাস্তবতার ভাঙনে। আনন্দ আর বেদনার এই বিপরীতমুখী সহাবস্থান যেন দিনকে দিন আরও প্রকট হচ্ছে। বৃষ্টিতে কারো মন নাচে, আর কারো বুক ভারী হয়।
আপনার মতো বৃষ্টি নিয়ে আমার অতো রসের কথা বের হয় না।
আমি চেষ্টা করলেও হয়তো পারবো না বৃষ্টিকে নিয়ে গদ্য-পদ্য রচনায় মন দিতে। কারণ আমি বৃষ্টিতে ঘুমাতে পারি না।
এই ‘না পারা’ই হয়তো আমাদের মধ্যকার সবচেয়ে বড় পার্থক্য। আপনি যখন তন্দ্রায় ডুবে যাচ্ছেন বৃষ্টির শব্দে, আমি তখন সেই শব্দের প্রতিটি ফোঁটার নিচে চাপা পড়ছি। রাতের নিস্তব্ধতায় যখন ঝমঝম শব্দ আপনার হৃদয়ে সুর তোলে, তখন আমার জন্য সেটা যেন এক করুণ ক্রন্দনের মতো।
আর আপনি টিনের ঘরে না ঘুমিয়েই লাইনের পর লাইন লিখে ফেললেন।
হ্যাঁ, আপনার লেখার মাঝে সৃজনশীলতার সুবাস আছে, আছে প্রশান্তির ছোঁয়া। কারণ আপনি টিনের ঘরে নেই, সেই শব্দ আপনার বাস্তবতা নয়। আপনার ছাদের ওপর থামলে পানি, আমার ঘরের ভেতর ঢোকে তা। আপনি অনুভব করেন শব্দ, আমি অনুভব করি শীতলতা, ভিজে যাওয়া চৌকির অস্বস্তি।
বৃষ্টি যখন টিনের উপরে পরে তখন মনে হয় মায়ের হাত বুলিয়ে দেয়ার কথা। আর নিমিষেই ঘুমিয়ে পড়েন।
এই অনুভূতি সত্যিই চমৎকার। মা যেমন কোমল স্পর্শে সব কষ্ট ভুলিয়ে দেন, তেমনি বৃষ্টির টিনে পড়ার সেই শব্দ আপনাকে শীতল স্বপ্নে ভাসিয়ে নেয়। হ্যাঁ আপনার ঘুম হবে।
ঘুম আপনার জন্য ন্যায্য। কারণ তখন আপনি টিনের ঘরে নয়, দালান ঘরে এক মস্তবড়ো বাড়িতে রয়েছেন।
আপনার মাথার ওপর ছাদ নয় শুধু, আছে নির্ভরতা। আছে নিরাপত্তা, আছে এমন এক পরিসর যেখানে বৃষ্টি শব্দ নয়, বরং পটভূমি। কিন্তু আমি? আমি সেই শব্দের নিচে পড়ে থাকি—ভিজে যাওয়া চৌকিতে, বিছানার পাশে গামছা বিছিয়ে রাত পার করি।
আপনি যখন ঘুমাচ্ছেন তখন আমার ঘরে হাঁটু সমান পানি,
আমার ঘরের মেঝে তখন আর মাটি নয়, যেন ছোট একটি জলাশয়।
যে পানি সেচ দিতে দিতে সকাল হয়ে যায়, আমি রুটি রুজির খোঁজে বাইরে বেরিয়ে পরি,
জীবনের এই নিত্য যুদ্ধ যেন শেষ হবার নয়। সারা রাত পানি সেচে কাটিয়ে আবার ভোরে সেই ভেজা পা নিয়ে রিকশার হ্যান্ডেল ধরি, বা কোন গার্মেন্টসের ছাদে যাই শ্রম বিক্রি করতে।
আর তখন আপনি ঘুমিয়ে থেকে রোমান্টিক স্বপ্ন দেখেন।
হয়তো সেই স্বপ্নে আপনি কোনো কাব্যিক দৃশ্য আঁকেন, কোনো ভালোবাসার গল্প লেখেন। কিন্তু আপনার সেই স্বপ্নের ঠিক উল্টো প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে আমার বাস্তবতা। এই দুই মেরুর জীবন একই বৃষ্টির নিচে কীভাবে এত ভিন্ন হতে পারে, সেটাই ভাবি।
No comments